যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ
এটি জীবনের মুলমন্ত্র । তবুও এই খারাপ দিনগুলোর মাঝেও কিছুমহৎ ও শিক্ষনীয় গল্প থেকে যায় যা সামনের দিনগুলোর প্রতি মূহুর্তে জীবনকে প্রফুল্লিত করে ও সমাজ, দেশকে নতুন করে জানার সুযোগ করে দেয় ।
সেই ২০১৯ সালের এক মিষ্টিময় সকালের কথা। মধুর সকাল কার না ভাল লাগে বাংলার এই সূর্যের হাসি যেনো পুরো হৃদয়কে আনন্দিত করার মতো, তবে এর প্রতিফলন সাবিহার মাঝে মাঝে তার মনে কেমন জানি বিষাদ স্পর্শ করে আছে। অবুঝ মনে কেমন জানি রিক্ততার বেদনা। আজ তার যাওয়ার সময় হয়ে গেলো ঢাকার উদ্দেশ্যে । ঈদের ছুটি দীর্ঘসময় গ্রামে অতিক্রম করার পর সবাইকে ছেড়ে পাড়ি জমায় ব্যস্ততার পথে । আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর কান্নার রোল পড়ে যায় তাদের অনপুস্থিতিতে । সাবিহা তার পিতা মাতা ভাইবোনের সাথে তাদের চার চাকার যানবাহনে প্রবেশ করেন ঢাকায় পথে । লম্বা সফরে কেমন জানি এক বিরক্ততা চলে আসে,এই দীর্ঘ ক্লান্তি দূর করার জন্য গাড়ী চালক রেডিও চালু করেন । এমন সময় শুরু হয় বিবিসি এর ৮টার খবর, যেখানে প্রচারিত হয় সিরিয়ার হৃদয় কাঁপানো হত্যা কান্ড,ইউক্রেন ও পুরো জগতের রক্তের এক মাতাম । ফলে সাবিহার মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে । তাই সে আকাশের পানে তাকিয়ে খোদার সাথে কথা বলছিলো সিরিয়ার অমানবিক হত্যাকান্ড নিয়ে । যেন খোদা তার নিকটে । সে ভাবছে ও বলছে কি করে একে অপরকে হত্যা করতে পারে । মানবতা ও বিবেক কি বিলুপ্ত হতে চলেছে,কি করে বন্ধ হবে ক্ষমতার লড়াই,রক্তের গন্ধ অপরদিকে,তার মাতা পড়ছিলো গ্রন্থমালা, বাকিরা গাইলো জীবনের গান,খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেনীতে পৌছে গেলো । ফেনীর যাত্রা পথে হঠাৎ কেমন জানি জোরে বিকট শব্দ হলো,মনে হলো বোধ হয় কেয়ামত না জানি চলে আসলো, কে জানি গাড়ির দিকে কিছু ছুড়ে মারলো । ফলে সাবিহার পরিবারের মন আতংকিত হয়ে উঠলো,গভীর রাতে গাড়ি চালক গাড়ি হাইওয়েতে থামালো । সাবিহার পিতা ও গাড়িচালক গভীর অন্ধকারে বের হলো আওয়াজের কারণ পরীক্ষা করতে । তাদের পরীক্ষার সময় খুব বেশি দীর্ঘ হওয়ায় হঠাৎ ছয়জন মুখোশধারী ডাকাত সমস্ত কিছু ছিনিয়ে নিয়ে ধারালো হাতিয়ার চাপাতি,বটি দ্বারা – পিতা, ড্রাইবারকে মারার চেষ্টা করলো । হঠাৎ সাবিহার চোখ পড়লো গাড়ির স্বচ্ছ আয়নার বাহিরের দিক,সে বুঝে উঠতে পারছিলো না কোথায় গেলো তার বাবা,গাড়িচালক। সেখানে নেই কোনো মানুষ, যেনো এক নিস্তব্দ পরিবেশ,এক ভয়ানক অন্ধকার,নেই কোনো মানুষ আছে কেবল খাল নদীনালা। এমতাবস্থায় সাবিহা তার একখানা ফিতাবিহিন ব্যাগটা নিয়ে গাড়ি থেকে বাহির হয় ব্যাপারটা জানতে,মুহুর্তে তিনজন ডাকাত তাকে পেয়ে বসে,সে দেখলো তার বাবাকে দুইজন ডাকাত হাতিয়ার দ্বারা কাবু করে রেখেছে,অপরদিকে গাড়ি চালককে ধারালো শক্ত হাতিয়ার দিয়ে জখম করছে। সাবিহা তার পরিবারকে বাঁচাতে কাঁপা কাঁপা গলায় জোরে জোরে চিৎকার দেয়,কিন্তু কেউ আসেনি বাঁচাতে। এতো নির্জন জায়গায় কে বা আসবে,পরোঃক্ষণে সব গুলো ডাকাত সাবিহাকে পেয়ে বসে, সাবিহার মাথায়, গলা,পায়ের কাছে সবাই তার নিজ নিজ অস্ত্র দিয়ে ধরে রাখে। তখন একটা মুখোশ ধারী,কাপড়বিহীন লোক মনে হচ্ছিল যেন মাদক সেবন করে আসছে,”সে বলে বসে গলা দেখা”, সে তার আত্মসম্মানের জন্য খুলেনি, তখন ডাকাতরা তাকে মারার চেষ্টা করে এমন সময় তার মা গাড়ি থেকে বাহির হয়ে ডাকাত গুলোর পায়ে ধরে বলতে থাকেন,” আমার কাছে এই দুটো স্বর্ণ ছাড়া আর কিছুই নেই,পরিবারকে ছেড়ে দিন কিছুই নেই আমাদের কাছে যা ছিলো সব আপনাদের কাছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি,যেনো তারা নিষ্ঠুর সব ছিনিয়ে নিয়েও তাদের মন অশান্ত,সাবিহার পরিবারের রক্তের জন্য যেনো উওেজিত। সাবিহার পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একে অপরকে রক্ষার্থে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে লড়াই করলো, সাবিহা মাঝ পথে চলে গেলো দৌড়ে,ডাকাতদের ধাক্কা দিয়ে,চিৎকার করলো সাহায্যের জন্য সব বাস,ট্রাক,এমনকি পুলিশের গাড়িও কেউ থামেনি, যেনো তারা দেখেও বোধ হয় অন্ধ। এতগুলো হাতিয়ার ও মানুষরুপী হিংস্র জানোয়ারদের কাছে তাদের নিজেদের টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল । যেনো খোদার আরশ আজ স্তম্ভ । বহু চেষ্ঠা ছুটাছুটি,হাতাহাতির পর সাবিহা ও তার পরিবার বাহনে উঠলো,কিন্তু যিনি বাহনটি চালাবেন তিনি পুরোপুরিভাবে রক্তাক্ত হয়ে পড়েন। সে তার হাত দিয়ে গাড়িতে চালাতে পারছিলো না, কারণ তার দুটো পা পুরোপুরি তার জায়গা থেকে সরে গিয়েছিলো। কিন্তু সাবিহার পরিবার প্রত্যেকে নিরুপায় ছিলো কেউ গাড়ি চালাতে জানতো না,এদিকে প্রাণ হারানোর ভয়,ও ডাকাতরা সাবিহার বাবা মার দিক রক্তিম চোখে তাকিয়ে সবাইকে গাড়ি থেকে টানাটানি করছে রড দিয়ে মারছে। তা দেখে গাড়ি চালক দুটো ভাঙগা পা হাত দিয়ে যন্ত্রে রাখেন ও কোনো রকম আগে পিছে না থাকিয়ে,গাড়ির দরজা বন্ধ না করে খানিকটা মাইল পার করে,পরিস্থিতি এমন যেনো মৃত্যুর দূত থেকে আসার সময় হয়ে গেছে।
কত আহাজারি করলো,কত চিৎকার,যেনো সব থেকেও আজ নিজ প্রাণের কাছে নিঃস্ব । তাদের চিৎকারে খোদার আরশ কেঁপে উঠলো,কথায় আছে,”খোদা রাখলে মারে কে?” মাইলের পর মাইল কি করে যে পার হলো ভাবলে শরীলে কাপনি ধরে।
মুহুর্তে সমস্ত নির্জন এলাকা পার হয়ে একটা ছোট দোকানের পাশে থেমে যায়, সাথে সাথে গাড়ি চালক গাড়ি থেকে বেহুশ হয়ে পড়ে যায়।সেই দোকানে বেশ পাচ থেকে ছয়জন সেলাইবিহীন কাপড় পরিহিত লোক ছিলো,তাদের দেখে সাবিহার মনে হচ্ছিল বোধহয় বিশ,চল্লিশের এদিক সেদিক। তারা দেখতে পেলে এবং সাবিহা ও তার পরিবারকে বাঁচাতে আসেন,তারা সমস্ত ঘটনা শুনে সাবিহাকে বলেন, ” আপা,এটা তো নিত্যদিনই ঘটে মানুষ বেঁচে ফিরে না। লাশ হয়ে যায়,মেরে পানিতে ফেলে দেয় ,আপনাদের আল্লাহ বাঁচিয়েছে, আমরা জেনেও কিছু করতে পারিনা। আমরা যাবো কয়,কারে বলবো ”। তারপর, তারা সাবিহা ও তার পরিবারকে ফেনী হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো, কোনো ডাক্তার তাদের চিকিৎসার জন্য নিচ্ছিল না, তবুও শত অনুরোধের পর তাদের মনুষ্যুত্ব জেগে উঠে, ভিতরে ছিলো দুইটা পাখা, এক বেডের রুমে তার পরিবারকে নিয়ে যায়,কিন্তু হাসপাতালের অবস্থা দেখে হতবাক সাবিহা ও তার পরিবার সেখানে নেই কোনো ঔষধ, না আছে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি যা দিয়ে রক্তের জলস্রোত কমাবে , এমনকি ডাক্তার নার্স তো এটাই জানে না কিভাবে চিকিৎসা দিতে হয়, যেনো আজ তারা ডাক্তার হয়েও অজ্ঞ।
তবে, যারা বাঁচিয়েছিলো সে মানুষ গুলো নিজ খরচে ফার্মেসী থেকে ও বিভিন্ন জায়গা থেকে দ্রুত ঔষধ সরবরাহ করেন । অতপর ঘন্টাখানিক পর পুলিশ আসলো কারণ জানতে কিন্তু তারা সাবিহার পরিবারের একটা কথাও শুনলো না, তাদের আসা যেনো না আসার সমান বরং সাবিহার কাছে মনে হলো যেনো তারা অবহেলা করছে ব্যাপাটাকে। আর কোনো উপায় না পেয়ে লোকগুলো সাবিহার পরিবারকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার পথে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। অতপর তা দেখে সাবিহা জিজ্ঞেস করলো, “কেন এতো সাহায্য যেখানে বাকিরাই হাত বাড়াইনি সাহায্যর্থে”। তার বললো, “ ভিন্ন চেহারার মানুষ হইতে পারি আপা তবুও আমরা এক রঙ্গের রক্ত মাংসের মানুষ তো, আপনাদের উপর দয়া করলে সৃষ্টিকর্তাও আমাগোর উপর দয়া করবো” । এরুপ কথা শুনে সাবিহা তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠাকে ধন্যবাদ জানায় ।
আজ সাবিহার ভাবনায় একটা নয় হাজারো কথা ভীড় করে, “আমার মাতৃভূমিতে আজও মানবতার গান, সম্প্রীতি, ঐক্যের, শক্তি ও খারাপের মাঝেও ভালোর অস্তিত্ব বিরাজমান । একমাত্র মনের শক্তি বড় শক্তি, মনের পবিত্রতায় বড় পবিত্রতা । মনের বলেই পরিচালিত হয় তারণ্যের শক্তি, ধর্মীয় সম্প্রীতি, সার্বজনীন বাংলাদেশের জয়গান । কিন্তু তার মনে এ ভাবনাও জাগে এই রক্তের খেলা কি কখনও থামবে না, সুদ, ঘুষ হত্যার উর্ধে কি হবে দেশ।
যেনো আজ প্রশ্নবিদ্ধ আর কত মানুষকে রাতের পর রাত প্রাণের ত্যাগের শিকার ও চিকিৎসার অবহেলায় জীবন হারাতে হবে। আর কত দিন অকালে সুখের বিসর্জন দিতে হবে। জীবনের কি কোনো মূল্য নেই, এতোই কি সস্তা..??
চলবে…